ভেড়ামারা উপজেলার শেষ প্রান্তে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ। এটি অনেক আগের তৈরী ব্রীজ যা সম্পুন্ন লোহার.
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ওয়ারেন্টি ও গ্যারেন্টি শেষ হয়েছে বলে একাধিক সুত্র থেকে জানা গেছে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ১০০ বছর অতিক্রম করায় আগামী ৪টা মার্চ’১৫ রোজ বুধবার দুপুর ২টার সময় হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে একাধিক সংগঠন নানা কমসূচি গ্রহন করেছে।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আজ থেকে ১২৬ বছর আগে ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত উপমহাদেশের রেল যোগাযোগের ব্যাপকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর রেল সেতু নির্মানের পরিকল্পনা করে। বিশেষ করে ভারতের দার্জ্জিলিং ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে যাতায়াতের সুবিধার্থে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার সীমারেখা পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মানের প্রক্রিয়া শুরু করে।
হার্ডিঞ্জ ব্রীজটি ১৯১২ সালে পদ্মা নদীর ওপর স্থাপন করা হয়। সে অনুযায়ী বর্তমান ২০১৫ সালে ১০০ বছর পার হয়েছে। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় তৎকালীন ব্রিটিশকরকার ১০০ বছরের গ্যারেন্টি দিয়েছিল যে, এ সময়ের মধ্যে ব্রিজটির কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটবেনা। সে অনুযায়ী আসলেই তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
সেতু বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে ও নেম ফলকে ১৯১২ সালে স্থাপিত দেখে জানা যায়, ২০১২ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ১০০বছর পূর্ন হয়েছে। ঐ সময় পদ্মা নদীর পূর্ব তীর বর্তমান কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গোলাপনগর সাঁড়াঘাট অপর দিকে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়াঘাট ছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী বন্দর। যেখানে দেশী-বিদেশী বড় বড় স্টীমার লঞ্চ, বার্জ, মহাজনী নৌকা ইত্যাদি ভিড়তো সাঁড়া বন্দরের ১৬টি ঘাটে। এমতাবস্থায় খরস্রোতা পদ্মা গর্ভে বহু লঞ্চ, স্টীমার ডুবে প্রাণহাণী ও মালামালের ক্ষতি সাধিত হয়। বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভারতের দার্জ্জিলিং ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে দেশী-বিদেশী পর্যটক যাতায়াত ও মালামাল পরিবহণের সুবিধার্থে ভাতের কাঠিহার থেকে রেলপথ আমিন গাঁ আমনুরা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে অবিভক্ত ভারত সরকার তখন পদ্মা নদীর ওপর ব্রীজ তৈরীর প্রস্তাব পেশ করে। তারই ধারাবাহীকতায় ১৮৮৯ সালের ব্রীজ তৈরীর সেই প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে ১৯০২ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে ব্যাপক স্টাডি করে ম্যাচ এফ জে ই¯িপ্রং একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরী করে। দীর্ঘ জরিপের পর সাঁড়া ঘাটের দক্ষিণে ব্রীজ নির্মানের সম্ভাব্যতার তথ্য সরকারের কাছে সরবরাহ করে এবং ১৯০৭ সালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মধ্যবর্তী পদ্মা নদীর ওপর ব্রীজ নির্মাণের পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে। ১৯০৮ সালে ব্রীজ নির্মাণের মঞ্জুরী লাভের পর ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম গেইলসকে ইঞ্জিনিয়ার ইনচীফ হিসাবে, ব্রীজের মূল নকশা প্রণয়নের জন্য স্যার এস এম বেনডেলেগকে ও প্রকল্প প্রণয়ন জন্য স্যার ফ্রান্সিস ¯প্রীং এবং ঠিকাদার হিসাবে ব্রেইথ ওয়াইট এন্ড কার্ক’কে দায়িত্ব¡ দেয়া হয়।
১৯১২ সালের আগে শ্রমিক সংখ্যা কম থাকলেও ১ ফেব্রুয়ারী ১৯১২ থেকে প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় তখন থেকে ২৪ হাজার ৪ শত শ্রমিক যারা দীর্ঘ ৫বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ব্রীজটির কাজ শেষ করে। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারী পরীক্ষামূলক ভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম মালগাড়ি (ট্রেন) চালানো হয়। ২ মাস পর ৪ মার্চ ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহি ট্রেন চলাচল শুরু করে। সে সময় ব্রিজটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন, তৎকালীন ভাইস রয় লর্ড হাডিঞ্জ। তার নামানুসার ব্রীজটির নামকরণ হয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রীজ।
এরপর শুরু হয় কূপ খনন, বসানো হয় ১৫টি স্প্যান যার প্রতিটি বিয়ারিং টু বিয়ারিং এর দৈর্ঘ্য ৩শ ৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২শ ৫০ টন। রেল লাইনসহ ১ হাজার ৩শ টন, এছাড়াও দু’পাশে ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে যার দুরত্ব ৭৫ ফুট। ব্রীজটির মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮শ ৯৪ ফুট (১ মাইলের কিছু বেশি)। ব্রীজ নির্মাণে মোট ইটের গাথুনি ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ইস্পাত ৩০ লাখ টন, সাধারণ সিমেন্ট ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম এবং কিলডসিমেন্ট (বিশেষ আঠাযুক্ত) লাগানো হয় ১২ লাখ ড্রাম।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১ হাজার গজ ভাটি থেকে ৬ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত ১৬ কোটি ঘন ফুট মাটি ও ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার ঘনফুট পাথর ব্যবহার করে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৩ কিলোমিটার প্রস্থ নদীর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা- পাবনার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ স্থলে দু’পাশে বাঁধ দিয়ে ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার নদী সংকুচিত করা হয় এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের সময় ব্রিজটির অ্যালাইনমেন্টে নদীর পানির বহন ক্ষমতা দাড়ায় ২৫ লাখ ঘনফুট।
তখনকার সময় ব্রীজটি তৈরীতে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১শ ৬৪ টাকা। এর মধ্যে স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭শ ৯৬ টাকা, ল্যান্ড স্প্যানের জন্য ৫ লাখ ১৯ হাজার ৮শ ৪৯ টাকা, নদীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩শ ৪৬ টাকা ও দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১শ ৭৩ টাকা। টাকার মান হিসাব করতে গেলে গ্রামের কয়েক জন দর্শনার্থীর উক্তি শুনে বোঝা যায় ‘ব্রিজটির বড় বড় লোহার গাডার দেখে মন্তব্য করেন পাঁচ’শ টাকার নোহাই লেগেছে!” প্রবাদ আছে ১ টাকায় ১৬ মন চাল পাওয়া যেত সে সময়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ সরকারের র্নিমিত ব্রিজটির খ্যাতি বিশাল পরিচয় বহন করে। বর্তমান জগতে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের চেয়েও লম্বা ব্রিজ ও সেতু অনেক আছে। কিন্তু কিছু কিছু কারণে এ ব্রীজটি অপ্রতিদ্বন্দীভাবে বিখ্যাত। প্রথম কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের ভিত গভীরতম পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১৬০ ফুট বা ১৯২ এমএসএল মার্টির নিচে। এর মধ্যে ১৫ নম্বর স্তম্ভের কুয়া স্থাপিত হয়েছে পানি নিম্নসীমা থেকে ১শ ৫৯ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১শ ৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থ্যাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১শ ৪০ ফুট নীচে। সে সময় পৃথীবিতে এ ধরনের ভিত্তির মধ্যেই এটাই ছিল গভিরতম। বাদ বাকি ১৪টি কুয়া বসানো হয়েছে ১৫০ ফুট মাটির নিচে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের জন্য রিভার ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে তাও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। ব্রীজটি অপূর্ব সুন্দর ও আর্কষনীয় হওয়াতে ব্রিটিশ ইনচীফ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস’কে সাফল্যের পুরস্কারস্বরূপ স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী ব্রিজটির ওপর একাধিক বোমা বর্ষন করে এর ফলে পিলারের ওপর থেকে ১২ নং স্প্যান (গাডার)টির এক প্রান্ত নদীর মাঝে পড়ে যায়। ৯ নং স্প্যানটির নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (যদিও পাকহানাদার বাহিনী না ভারতীয় বাহিনী ব্রিজটিতে বোমা বর্ষন করে তা নিয়ে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। পাক বাহিনীকে দক্ষিন বঙ্গে প্রবেশ না করতে দেওয়ার কৌশলগত কারনে পিলারের ওপরে এবং গাডারের নীচে ডিনামাইন্ড বসিয়ে ওপর থেকে বোমা মেরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।) ফলে উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর যে বোমা দ্বারা হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ক্ষতিসাধন করা হয় তা এখনো পাকশীস্থ বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজারের কার্যালয় সামনে সংরক্ষিত রয়েছে।
পরে ব্রীজটি মেরামত করে ভারতের পূর্ব রেলওয়ে শ্রী এইচকে ব্যানার্জী, চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী আরকে এসকে সিংহ রায়, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার, শ্রী পিসিজি মাঝি, এ্যাসিসন্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এছাড়াও বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ছিলেন রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ আলী, ইঞ্জিনিয়ার ইন চীফ ইমাম উদ্দিন আহমেদ, ডিভিশনাল সুপার এম রহমান, প্রমূখ। মেরামতকৃত গাডারটি বর্তমানে কিছুটা দেবে গেছে, ফলে ট্রেন চালকরা গাড়ীর গতি কমিয়ে ব্রিজ পারাপার হয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস